ছোট ভাইয়া, আপনার প্রতীক্ষায় আর কতদিন থাকব?

১৯৮৪ সালে এস এস সি পরীক্ষার পর আমান ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন সেনানিবাসে তিন সপ্তাহ সময় কাটাই। এই ছবিটি সে সময়ে তোলা।

ছোট ভাইয়া, আপনি কি বেঁচে আছেন? কেমন আছেন? কোথায় আছেন? কি করছেন? ওরা আপনার সাথে কেমন আচরণ করে? ওদের কি কোন মায়া হয়না? আপনার কষ্ট তাদের বুকে আঘাত করেনা? মানুষের হৃদয় এত পাষাণ কি করে হয়? তাদের নিজেদের পরিবার নেই? তারা বোঝেনা বিনা কারণে পরিবার থেকে দুরে রাখা কত নিষ্ঠুর কাজ? তারা কি মুসলমান? আল্লাহ্‌কে ভয় করে? পরকালে বিশ্বাস করে? তারপরও কিভাবে নির্বিকার থাকে? কিভাবে পারে আপনি ও আরমান সহ শত শত পরিবারকে প্রিয়জন হারানোর এই ব্যথা দিতে?

মনে পড়ে ২২শে আগস্ট ২০১৬ এর সেই ভয়াবহ দিনের কথা। হঠাত ফোন আসল যে সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের ৩০/৪০ জনের একটি দল আমাদের বাসায় আক্রমণ করে, ত্রাস সৃষ্টি করে, বাড়ীর কেয়ারটেকারকে মারধোর করে, আম্মা ও ভাবীকে হুমকী দিয়ে, ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে তালাশ করে, অবশেষে আপনাকে চোখ বেধে ধরে নিয়ে যায়। ফোনে ভাবীর সেই আর্তনাদ এখনও আমার কানে বাজে। আম্মাতো কথাই বলতে পারছিলেননা। এরপর কত প্রচেষ্টা, কত লোকের কাছে ধরনা দেয়া, কত যায়গায় ছোটাছুটি করা – কোন কিছুতে কোন লাভ হলোনা। পুলিশ সাধারণ ডায়েরী পর্যন্ত নিলনা। পরিবারের মুখপাত্র হিসেবে আমি বিশ্বের বড় বড় পত্রিকা, রেডিও ও টিভিতে কত সাক্ষাৎকার দিলাম। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সাথে কত কথা বললাম। এ দেশের এম পি ও মন্ত্রীদের কাছে চিঠি লিখলাম। শেখ হাসিনার ভাগ্নী যিনি এখানকার সংসদ সদস্য, তাঁর কাছে চিঠি লিখলাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলনা। আপনাকে না পাওয়ার ব্যথা আমরা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি। কেউ আমাদের কথা শোনেনা। কারো কাছে আমাদের কান্না পৌছেনা। কারো বিবেকে নাড়া দেয়না।

ছোট ভাইয়া, আপনি ছিলেন আব্বা-আম্মার একমাত্র হাতের লাঠি। আমাদের কাউকে ওরা দেশে যেতে দেয়না, তাই আপনার একার উপর দায়িত্ব পড়ে আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মার দেখাশুনা করার। কি সুন্দরভাবে আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন। আব্বা জেলে যাওয়ার পর থেকে আম্মাকে কিভাবে সামলেছেন তা আমরা সবাই জানি। আপনার ত্রিশ বছরের বর্ণাঢ্য সামরিক জীবনের অবসান হয় অপমান ও লাঞ্ছনামূলক বরখাস্তের মাধ্যমে যার কোন কারণ পর্যন্ত ওরা দেখায়নি। কিন্তু আপনি এতে দমে যাননি। চেষ্টা করেছেন স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলতে। ওরা তাও করতে দিলনা। এরপর পুরো সময় নিয়োজিত করলেন আব্বা-আম্মার সেবায়। আব্বার ইন্তেকালের পর ছয় ভাইয়ের দায়িত্ব আপনি একা পালন করলেন, কারণ ওরা আমাদের দেশে যেতে দেয়না। এরপর আম্মাকে সামলালেন কত সুন্দরভাবে। কিন্তু আম্মার সামনে দিয়েই আপনাকে ওরা নিয়ে গেল। সাড়ে তিন বছরের আকিফা আর দেড় বছরের আফিফের ভীত চেহারা ওদের একটুও হৃদয় কাপালোনা। নিয়ে গেল আপনাকে সবার চোখের সামনে দিয়ে। এরপর প্রায় তিন বছর আম্মা বেঁচে ছিলেন । অপেক্ষা করতেন কবে তাঁর প্রিয় সন্তান মায়ের কোলে ফিরে আসবে। আমাদের সাথে কথা বলার সময় তাঁর ডুকরে কেঁদে ওঠার মুহূর্তগুলি মনে পড়লে ভীষণ মুষড়ে পড়ি। আম্মা বলতেন, “আমার কবর বোধ হয় তোমরা কেউ দিতে পারবেনা।” আমরা সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করতাম এবং আশা প্রকাশ করতাম যে আপনি ফিরে আসবেন। কিন্তু তা আর হলোনা। আম্মা তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে আল্লাহ্‌র কাছে চলে গেলেন।

আচ্ছা, ওরা কি আম্মার ইন্তেকালের খবর আপনাকে দিয়েছিল? কিভাবে দিয়েছিল? আমরা সব ভাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি, কিন্তু আপনি কিভাবে এ সংবাদ সহ্য করলেন? আপনিতো কাঁদার জন্য কোন কাঁধও পেলেন না।

ছোট ভাইয়া, আপনি কি জানেন আপনার বড় মেয়ে নাবীহার জমজ দুটো ফুটফুটে ছেলে আছে? ওরা ভীষণ আদুরে ও চঞ্চল। ওরা কি ওদের নানার কোলে উঠবেনা? নায়েফ আপনার মতোই সুপুরুষ হয়ে গড়ে উঠেছে মাশা আল্লাহ্‌। রাহমা আল্লাহ্‌র রহমতে স্কলারশীপ নিয়ে পড়ছে ও পড়াশুনায় খুব ভাল করছে। বড় তিনজন নিয়ে এত চিন্তা হয়না যা হয় ছোট দুজন নিয়ে। ওরা বাবা বাবা করে, কিন্তু বাবাকে আর পায়না। এত ছোট বয়সে কচি মনে ওদের যে আঘাত লেগেছে, তা আপনি ফিরে না আসলে কিভাবে ঠিক হবে?

ছোট ভাইয়া, মনে আছে ১৯৮৪ সালের কথা যখন আপনার সাথে চট্টগ্রাম ও মাইনিমুখে কত চমৎকার তিনটি সপ্তাহ কাটিয়েছিলাম? দেশে যতদিন ছিলাম, আপনি যখন যেই সেনানিবাসে ছিলেন, সবখানে গিয়েছি। নিজের চোখে দেখেছি অফিসার ও সিপাহী নির্বিশেষে সবাই আপনাকে কত ভালবাসত। আপনার আচরনে সবাই কত মুগ্ধ ছিল। আপনার মতো অফিসারের সান্নিধ্য পাওয়ায় তারা নিজেদের ধন্য মনে করত। কিন্তু আজ কেউ আপনার কথা বলেনা। কারো সাহস নেই প্রতিবাদ করার। কেউ নেই বলার যে আপনার মতো ব্রিলিয়ান্ট অফিসারের সাথে এমন আচরণ আমাদের সেনাবাহিনীর সাথে অসাদাচরনের সমকক্ষ।

কেন ওরা আপনাকে নিয়ে গেল? ওরাতো জানত আপনি কেমন ছিলেন। আব্বাকে ওরা অন্যায়ভাবে নিয়ে গেল। কোন অপরাধ প্রমাণ ছাড়াই ৯০ বছরের সাজা দিল। তারপর সেখানেই তাঁর মৃত্যু হল। এতেও ওদের সাধ মিটলোনা? আপনাকে এভাবে নিয়ে যেতে হল? কেন? যে রাষ্ট্র নিজের সেনাবাহিনীর এত ব্রিলিয়ান্ট একজন অফিসারের সাথে এমন আচরণ করতে পারে, সে রাষ্ট্রের আত্নসম্মানবোধ বলতে কি কিছুই নেই?

ছোট ভাইয়া, আপনার প্রতীক্ষায় আমাদের আর কতদিন থাকতে হবে? কতদিন আপনার সন্তানরা বাবার অপেক্ষায় প্রহর গুনবে? ছোট্ট আকিফা ও আফিফ কবে আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারবে? আপনার যমজ দুই নাতী কবে ওদের নানার আদর পাবে? এর কোন জবাব কেউ কি আমাদের দিতে পারবে? মানুষের মৃত্যু হলে তাঁকে কবর দিয়ে দোয়া করা যায়। জেলে থাকলে তাঁর সাথে দেখা করা যায়। কিন্তু এ কেমন এক পরিস্থিতি যেখানে বেঁচে আছে কিনা তা জানারও উপায় নেই? এ কেমন অবিচার? আর কতদিন চলবে এই অপেক্ষার পালা?

হে আল্লাহ্‌, তোমার কাছেই হাত পাতি, মাথা নত করি, আর্জি করি। তাঁকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা কর। তিনিসহ গুম হওয়া সকল পরিবারের প্রিয়জনদের তাদের মাঝে ফিরিয়ে দাও।

14 thoughts on “ছোট ভাইয়া, আপনার প্রতীক্ষায় আর কতদিন থাকব?”

  1. Most balanced articulation of the deep and long pain in the family about our brother who was an asset for the army and country. I ask Allah to deal with any injustices done to him.

    Reply
  2. কেঁদেছি প্রচুর লিখাটি পড়ার সময়। দোয়া করেছি বলতে গেলে প্রতিটি লাইনের শেষে। কি করবো আমরা। আর দূর্বল ঈমানদার হিসাবে মনের মধ্যে এহেন কাজের জন্য ঘৃনা লালন করে রেখেছি।
    কালকে আপনাদের তিন ভাইয়ের রেকর্ডেড লাইভটি দেখেছি আর আজ আপনার লিখাটি পড়লাম।
    আমি নিশ্চিত এই ধরনের লিখা লিখতে গিয়ে লেখকরা নিজেরাও অনেক কাঁদেন।

    ডা: সাইফুল ইসলাম
    টরোন্টো, কানাডা।

    Reply
  3. আমি লিখেছি, আমি প্রতিবাদ করেছি আর আগামী কয়েক দিনের মাঝে ইনশাআল্লাহ আমি লাইভ শো তে এ নিয়ে কথা বলবো। স্যার আমাকে খুব আদর করতেন। যেখানেই আছেন আল্লাহ স্যারের দেখাশুনা করুন। এই কষ্ট প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই।

    মেজর দেলোয়ার হোসেন (অবঃ)

    Reply
  4. আপনার লিখাটা পড়ছিলাম। আর নিজের অজান্তেই চোখের পানি ঝড়ছিল। আপনাদের ত্যাগের দিকে তাকালে নিজেকে ইকামাতে দ্বীনের কর্মী হিসেবে অপরাধী মনে হয়। মহান আল্লাহ আপনাদের প্রতি রহম করুক। প্রিয় আজমী ভাইকে ফিরিয়ে দিক

    Reply
  5. ভাই আপনার লেখাটা পড়ে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আপনাদের সান্ত্বনা জানানোর ভাষা ও আমাদের জানা নেই। মহান মনিবের কাছে কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ করি তিনি যেন আপনাদের ইয়াকুব (অঃ) এর মত সবরে জামিল করার তৌফিক দান করেন। আমীন।

    Reply
  6. Bhasha nai ai nirmom ghotoner shantona likbo kivabey. Shudhu jani er tripti dayok purosker asey akhiratey. Ai shantonai shantona. Oi din porjonto eto boro dukkho bohon korlai mohan Allahr hridoy jurano purosker paowa jabey InshaAllah.

    Reply
  7. হে মালিক তুমি সব জান বুঝ। তোমার কাছে বিচার দিলাম। বুক ভরা কান্না আওয়াজ তুমি দেখছ কবুল করে নাও।

    Reply
  8. আল্লাহ আপনাদের পরিবারকে ধৈর্য ধারণ করার তৌফিক দান করুক,,

    Reply

Leave a Comment