সেই ভারত, এই ভারত

(এই লিখাটি ২১ জুলাই ২০২২ তারিখে আমার দেশ পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।)

সেই ভারতে মুসলমানরা অধিকাংশ সময় একজন সাধারন ভারতীয় হিসেবে জীবন যাপন করতে পারত। আর এই ভারতে একজন মুসলমান হওয়া এক আতঙ্কের নাম।

সেই ভারত হচ্ছে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত আমার নিজের চোখে দেখা ভারত।  তখন আমি ঐতিহ্যবাহী আলীগড় মুসলীম বিশ্বাবিদ্যালয়ে অনার্স ও মাস্টার্সের ছাত্র অবস্থায় খুব কাছে থেকে দেশটিকে দেখেছি। আর এই ভারত বলতে আমি নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্বাবাদী ভারতের কথা বোঝাচ্ছি। সেই ভারত ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। আর এই ভারত শুধুমাত্র একটি সাম্প্রদায়িক দেশই নয়, বরং একটি বর্ণবাদী দেশে পরিনত হয়েছে। সেই ভারতে মুসলমানরা অধিকাংশ সময় একজন সাধারন ভারতীয় হিসেবে জীবন যাপন করতে পারত। আর এই ভারতে একজন মুসলমান হওয়া এক আতঙ্কের নাম। এই ভারত এখন যে পথে হাটছে তাতে এ আশংকা অমুলক নয় যে ধীরে ধীরে ভারতের মুসলমানদের অবস্থা নাৎসি জার্মানির ইহুদীদের মত হয়ে যেতে পারে।  এই লিখায় আমি আমার দেখা ভারত ও বর্তমান ভারতের মধ্যে কি কি পার্থক্য আমি লক্ষ করছি তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার চেষ্টা করব। 

এতে কোন সন্দেহ নেই যে ৯০ দশক কেন, কোন সময়ই ভারত একটি আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছিলনা। গান্ধী ও নেহেরুর স্বপ্নের ভারতে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষদের শান্তিতে একত্রে বসবাস করার কথা। ধর্মনিরপেক্ষতার মুল মন্ত্রই হচ্ছে যে রাষ্ট্রে  কোন একক ধর্মের আধিপত্য চলবেনা, সকল ধর্মের অনুসারীরা সে দেশে সমান অধিকার পাবে।  ১৯৪৭ সাল থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত ভারতে সে ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা দেখা যায়নি এটা সত্য। শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলীম দাঙ্গাই নয়, ১৯৮৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর শিখ দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হবার পর সারাদেশে শিখ সম্প্রদায় হিন্দুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। আমি আলীগড়ে পড়ার সময় ১৯৯০ ও ১৯৯২তে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলীম দাঙ্গা দেখেছি। তারপরেও বলতে হয় যে ভঙ্গুর ও সমস্যা জর্জরিত হলেও ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ ভারতে বেশীরভাগ সময়েই মোটামুটি বিরাজমান ছিল। কিন্তু এখন মোদীর ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার একেকটি স্তম্ভ উপড়ে ফেলে দেশটিকে একটি উগ্র হিন্দু রাষ্ট্রে পরিনত করা হয়েছে। কয়েকটি উদাহরন দিলেই বোঝা যাবে সেই ভারত ও এই ভারতের মধ্যে পার্থক্য। 

মন্দির-মসজিদের পাশাপাশি সহাবস্থান 

৯০ দশকের সেই ভারতে আমি আলীগড়ে পড়ার সময় একটি কথা প্রায়ই বলতাম যে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার একটি উদাহরন হল মন্দির ও মসজিদের পাশাপাশি অবস্থান যা তখন একটি নিয়মিত দৃশ্য ছিল। উপাসনালয়ে আক্রমন তখন খুব কম হত। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে ভারতে এক নতুন অধ্যায়ের সুচনা হলেও সাধারনভাবে মসজিদগুলো মোটামুটি নিরাপদই ছিল বলা যায়। সে সময় ভারতীয় জনতা পার্টি ছিল একটি উদীয়মান দল, এবং বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার পেছনে তারাই মুল ভুমিকা পালন করে। তারপরেও আমি থাকাকালীন সময় রাজনীতি ও মিডিয়াতে মসজিদ ও মুসলমানদের নিয়ে উস্কানীমুলক কথা খুব কমই শোনা যেত। অথচ এই ভারতের মসজিদ হচ্ছে উগ্র হিন্দুবাদীদের অন্যতম প্রধান টার্গেট। মাইকে আজানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া থেকে শুরু করে মসজিদ থেকে মুসল্লীদের পিটিয়ে বের করা ও মসজিদ আক্রমন করা সে দেশে এখন এক সাধারন ঘটনা। শুধু তাই নয়, তারা এখন মসজিদ্গুলোকে মন্দিরে পরিনত করার কাজ পর্যন্ত শুরু করেছে এবং মুসলীম স্থাপনাগুলোর ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি তারা প্রয়াগরাজ (এর নাম ছিল আল্লাহাবাদ যা বিজেপি পরিবর্তন করে হিন্দু নামকরন করেছে) শহরের একটি মসজিদের অযুখানার নীচের ঝর্নাকে শিবলিংগ বলে সেই মসজিদ দখলের পায়তারা শুরু হয়েছে।

গোমাংস ও মুসলমান

ধার্মীক হিন্দুরা গরুর গোস্ত খায়না এটা আমরা জানি । সেই ভারতে গরুর গোস্ত খুব একটা পাওয়া যেতনা। সে সময় শুধুমাত্র কেরালা ও পশ্চিম বাংলায় রেস্টূরেন্টে গরুর গোস্ত পাওয়া যেত কারন সে দুটি রাজ্যের ক্ষমতা ছিল কমিউনিস্টদের দখলে। তবে সেখানেও বড় বড় মুসলীম রেস্তোরায় no beef লিখা থাকত যাতে হিন্দু গ্রাহক মুখ ফিরিয়ে না নেয়। আমরা আলীগড়ে সাধারনতঃ গরু খেতে পারতাম না। মহিষের গোস্ত দিয়েই কাজ চালাতে হত। তবে তবে মাঝে মাঝে কসাইরা কাছে ডেকে চুপিচুপি বলত বিকেলে এসে গোপনে গরুর গোস্ত নিয়ে যেতে। তবে এই ভারতে গরুর গোস্ত পাওয়াতো দুরের কথা, এমন ঘটনা অনেক শোনা যায় যে উগ্র হিন্দুরা মুসলমানদের বাসার ফ্রিজ থেকে গোস্ত বের করে একে গরুর গোস্ত বলে পিটিয়ে মানুষ মারছে। এমন ঘটনার খবর এখানকার মিডিয়াতেও এসেছে যাকে  cow vigilante হিসেবে অভিহিত করা হয়। 

নাগরিকত্ব, বুলডজার ও বিজেপি

সেই ভারতে কারও বাড়ী বুলডজার দিয়ে ধ্বংস করা যেতে পারে তা ভাবাই যেতনা। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে সবার সমান অধিকার ছিল বাড়ী বানানো ও সেখানে বসবাস করা। কিন্তু এই ভারতে যেসব রাজ্যে বিজেপি সরকার আছে সেখানে মুসলমানদের মধ্যে এক আতঙ্কের নাম কবে বুলডজার দিয়ে তাদের বাড়ী গুড়িয়ে দেয়া হবে। সম্প্রতি প্রয়াগরাজে এক মুসলীম পরিবারের বাড়ী এভাবে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে কারন বাড়ীর কর্তা বিজেপি সরকারের কড়া সমালোচক ছিল এবং তার মেয়ে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রনেত্রী যে আবার হিজাবও পড়ে। যদিও ভদ্রলোকের স্ত্রী পৈত্রিক উত্তরাধিকারী হিসেবে বাড়ীর মালিক, তারপরও কোন আইনী প্রক্রিয়া ছাড়াই বাড়ীটিকে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এমন ঘটনা অন্যান্য শহরেও হচ্ছে। তাছাড়া বিজেপি যে নতুন নাগরিকত্ব আইন করেছে তাতে আসামে লক্ষ লক্ষ মুসলমান তাদের নাগিরিকত্ব হারিয়ে বিপদে পড়েছে। 

ইতিহাস বিকৃতি

সেই ভারতে মুসলীম ইতিহাস নিয়ে হিন্দুদের তেমন মাথাব্যথা ছিলনা। মুঘল শাষকদের অবদানকে তারা গর্বের সাথেই স্বীকার করত। তাজমহল বা লালকিল্লার মত বিখ্যাত নিদর্শনগুলোতে গেলে ট্যুর গাইডরা শুধুমাত্র আওরঙ্গজেব ছাড়া বাকী সকল মুঘল শাষকদের ব্যাপারে ভাল কথাই বলত। কিন্তু এই ভারতের বিজেপি সরকারের অন্যতম এজেন্ডা এখন ভারতের ইতিহাসকে বিকৃত করে মুসলমানদের আগ্রাসী, আক্রমনকারী, দখলদার, বিদেশী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে তাদের অবদানকে খাট করা। বর্তমান ভারতের সরকার ও মিডিয়া বিশেষ করে মুঘল শাষকদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে এবং তাদের শাষনামলকে খাট করে দেখানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা দিয়ে যে কাজ তারা শুরু করেছিল ৯০ দশকে, তা এখন তাজমহল, কুতুব মিনারের মত বিখ্যাত নিদর্শনগুলোকে আগে হিন্দু মন্দির ছিল এমন উদ্ভট দাবী করে এগুলো ধ্বংসের পায়তারা করছে। 

গোদি মিডিয়া ও প্রোপাগান্ডা

সেই ভারতে ইন্টারনেট ছিলনা, ছিলনা এতগুলো টিভি চ্যানেল। ৯০ দশকের শুরুর দিকে স্যাটেলাইট চ্যানেল আরম্ভ হলেও সেগুলো মুলতঃ ছিল বিনোদনমুলক। এখনকার মত এতগুলো নিউজ চ্যানেল ছিলনা। তাই টিভির মাধ্যমে মুসলীম বিদ্বেষ ছড়ানোর তেমন উল্লেখযোগ্য ঘটনা তখন ঘটতনা। আর এই ভারতে ইন্টারনেট ও টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে মুসলীম বিরোধী প্রোপাগান্ডা এখন চরম আকারে পৌছেছে। প্রতিদিন এসব টিভি চ্যানেলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লাভ জিহাদ, করোনা জিহাদ ইত্যাদি বিষয়ে উস্কানিমুলক আলোচনা করে এবং মুসলীম বিদ্বেষি রাজনীতিবীদ বা হিন্দু নেতাকে নিয়ে এসে এসব বিষয়ে হৈ চৈ করে। মাঝে মাঝে তারা হিন্দুদের বিরুদ্ধে বাজে কথা বলার জন্য কিছু অখ্যাত মুসলীম ব্যক্তিকে নিয়ে এসে এসব প্রোগ্রাম চালিয়ে অধিকাংশ হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার কাজ করছে। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিজেপি সমর্থক রিপাবলিক টিভি চ্যনেলের অর্নব গোস্বামী যার কাজ হচ্ছে মুলতঃ মুসলমানদের বিরুদ্ধে চিৎকার চেচামেচি করা। কুরুচীপুর্ন এসব প্রোগ্রাম এখন ভারতের মিডিয়াকে এমনভাবে চেপে বসেছে যে ভাল কোন আলোচনা দেখতে ভারতের টিভি দর্শকরা এখন অনেকটাই অপারগ।

বলিউডের অধঃপতন 

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ভারতের সমাজে থাকুক বা না থাকুক, একটি সেক্টরে ধর্মনিরপেক্ষতা সবসময়ে দেখা গেছে – আর তা হচ্ছে হিন্দী সিনেমা। হিন্দী সিনেমা আপনার ভাল লাগুক আর না লাগুক, আপনি এটা বলতে বাধ্য হবেন যে ৯০% এর বেশি হিন্দী সিনেমা ঐতিহাসিকভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কানি না ছড়িয়ে হিন্দু-মুসলীম ভাই-ভাই এমন বানী দেয়ারই চেষ্টা করেছে। যদিও একসময় দিলিপ কুমার (ইউসুফ খান), মধুবালা (মমতাজ জাহান) ইত্যাদি বলিউড কিম্বদন্তীরা তাদের নাম বদল করেছিলেন হিন্দী সিনেমায় সফল হওয়ার জন্য, কিন্তু পরবর্তীতে প্রখ্যাত তিন খান সহ (শাহরুখ খান, আমীর খান, সালমান খান) অনেক বিখ্যাত নায়ক-নায়ীকারা তাদের মুসলীম নাম নিয়েই জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছেন। আমার দেখা সেই ভারতে বলিউডে ধর্মনিরপেক্ষতা খুব ভালভাবেই বিরাজমান ছিল। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানী সঙ্গীত ও অভিনয় শিল্পীরা বলিউডে শুধু কাজই করতনা, তাদের বেশ সম্মানও দেয়া হত। কিন্তু এই ভারতের বলিউড এখন ধীরে ধীরে উগ্র হিন্দুবাদীদের দখলে চলে যাচ্ছে এবং ক্রমশঃ বিজেপির মুখপাত্রে পরিনত হতে চলেছে। ইতিহাসভিত্তিক সাম্প্রতিক কিছু সিনেমাতে কিছু ঐতিহাসিক মুসলীম শাষকদের ভিলেন বানানো থেকে এই কাজ শুরু হয়। সম্প্রতি ৯০ দশকে কাশ্মীর ছেড়ে হিন্দুদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দি কাশ্মীর ফাইলস নামক একটি ছবি কাশ্মীরি মুসলমানদের হিংসাত্বক বর্নবাদী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে এবং তা বক্স অফিসে সুপারহিট হয়েছে। অনুপম খের, অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগান, কাঙ্গানা রানোট ইত্যাদি জনপ্রিয় অভিনেতারা এখন প্রকাশ্যে বিজেপির পক্ষে কথা বলছে। নরেন্দ্র মোদীর সাথে সেলফি নেয়ার জন্য এখন বলিউডে রীতিমত প্রতিযোগীতা চলছে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ভারতের বলিউড হিন্দুত্ববাদ নিয়ে এতই ব্যস্ত যে ভাল সিনেমার সংখ্যা ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে। অপরদিকে দক্ষিন ভারতের সিনেমাগুলো এখনঈকের পর এক ব্লকব্লাস্টার ছবি বানাচ্ছে যার জনপ্রিয়তার কাছে বলিউডের সিনেমাগুলো পাত্তাই পাচ্ছেনা। 

শেষ কথা

৯০ দশকের সেই ভারত আর ২০২২ সালের এই ভারতের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। যদিও সেই ভারত মুসলমানদের জন্য খুব ভাল ছিল তা মোটেও বলা যাবেনা, কিন্তু এই ভারতের সাথে তুলনা করলে সেই ভারতকে মুসলমানদের জন্য অনেক নিরাপদ বলা যেতেই পারে। সেই ভারতে আমি নিরাপদেই ছিলাম, কিন্তু এই ভারতে আমি ভ্রমন করতে এখন নিরাপদ বোধ করবনা। এই লিখায় কয়েকটি উদাহরন দিয়ে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি এই দুই ভারতের মধ্যে পার্থক্য কি, কিন্তু একটি লিখা দিয়ে আসল সমস্যা তুলে ধরা একেবারেই অসম্ভব। আমি শুরুতেই বলেছি যে বর্তমান ভারতে যা হচ্ছে তা নাৎসি জার্মানীতে শুরুতে যা হয়েছিল, সেদিকেই যাচ্ছে। এটা শুধু আমার আশঙ্কা নয়, গনহত্যা বিশেষজ্ঞরাও এই কথা বলা শুরু করেছে। কেন এই আশঙ্কা তা নিয়ে আরেকদিন লিখার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ। 

লেখকঃ ডঃ সালমান আল-আযামী একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ভাষাবিজ্ঞানী। বর্তমানে তিনি ইংল্যন্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন।  

Leave a Comment