বাংলা ভাষায় ভাষাবিজ্ঞানীর অভাব ও আমার ভাবনা

এ বছর ২১শে ফেব্রুয়ারী ভাষা নিয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের আত্মত্যাগের ৭০ বছর পূর্ণ হবে। একজন ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে এ বিষয়টা আমাকে অনেক গর্বিত করে নিঃসন্দেহে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে যখনি কোন আলোচনা হয়, তখন বাংলা ভাষা নিয়ে আলোচনার সুযোগ এসে যায় এবং এ সুযোগ আমি পুরোপুরি কাজে লাগাই। প্রতি বছর ছাত্রদের মাঝে তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও আমাকে এ ব্যাপারে কিছু লিখতে বা বক্তব্য দিতে বলা হয়। পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে আমার লিখা প্রকাশিত হয়েছে । আর এ বছর ২৩ ফেব্রুয়ারী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠানে আমাকে এ বিষয়ে কিছু কথা বলতে হবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি একজন বাংলা ভাষাভাষী ভাষাবিজ্ঞানী কথা বলব সেটাই স্বাভাবিক, তাইনা? কিন্তু, সুধু পশ্চিমা বিশ্বেই নয়, বাংলাদেশের কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বাংলাদেশী ভাষাবিজ্ঞানী এ বিষয়ে বক্তব্য রাখার যোগ্যতা রাখে এ প্রশ্ন নিয়েই আমার আজকের এই লিখা।

UNESCO যখন মহান একুশে ফেব্রুয়ারী কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষনা করলো, তখন খুব আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম এই ভেবে যে বাংলা ভাষায় গবেষনা অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু সে আশা এখোনো পূরন হলোনা। আর হবেই বা কিভাবে? বাংলা ভাষায় গবেষনা করতে হবে বাংলা ভাষাভাষীদেরকেই। কিন্তু বাংলাদেশে গবেষনার পরিবেশ কতোটুকু? আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষনা কতটুকু হয়? গবেষনা হলে রাজনীতি হবে কিভাবে? তাছাড়া ভাষার উপর গবেষনার জন্য চাই পরিপূর্ন ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ। আজ পর্যন্ত তা দেখতে পেলামনা । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি বিভাগ আছে বটে তবে তাতে কি হয় তা আল্লাহই জানেন। তাদের একটি ওয়েবসাইট আছে বটে, তবে তাতে তেমন কোন তথ্যই নেই। আলীগড় মুস্‌লীম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয় ১৯৬৯ সনে। প্রতি মাসে সেখান থেকে ২/৩ জন পি এইচ ডি বের হচ্ছে। আর আমাদের দেশে ভাষাবিজ্ঞানী বের করার জন্য তেমন কিছুই করা হচ্ছেনা । এই দুঃখ রাখব কোথায়?

আমার PhD বাংলাদেশের বাংলা বিজ্ঞাপনের ভাষা নিয়ে। পরবর্তীতে যখন bilingualism-এ গবেষনা শুরু করলাম, তখনো বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করেছি। popular culture-এর ভাষা নিয়ে কয়েকটি গবেষণাপত্র লিখেছি । বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির ঐতিহাসিক এক ভাষণ নিয়ে একটি পেপার লিখছি। এগুলো আমার বিশেষত্বের উপর পড়ে বলে করতে পারছি। কিন্তু আমাদের দেশের ভাষা নিয়ে অনেক গবেষণার প্রয়োজন। এগুলো করবে কে? ভারতে তাদের দেশের আনাচে কানাচে যত ভাষা আছে তা নিয়ে গবেষণার জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান আছে যাদের একটিতে আমার দু সপ্তাহ কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। সেগুলো একেকটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত। অথচ আমাদের দেশে যে বাংলা একাডেমী আছে তার ওয়েবসাইটে গিয়ে গবেষণার তেমন কিছুই পাওয়া যায়না। আমাদের দেশের আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে একটি অভিধান করা ছাড়া আর কি কাজ হয়েছে জানার চেষ্টা করেও পেলামনা। আর যেসব ভাষা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো সংরক্ষণের কোন চেষ্টা আছে কি? কে চেষ্টা করবে? কাকে দিয়ে করবে? বাংলাদেশে এসব কাজ করার জন্য ভাষাবিজ্ঞানী কোথায়? Linguistics ডিগ্রীধারী এখন বাড়ছে বলেই জানি। কিন্তু তারা বেশীরভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং English Language নিয়েই ব্যস্ত। এমন অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগে। ভাষাবিজ্ঞান যখন এতটা প্রসার লাভ করেনি তখন বাংলা ভাষা ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লার মতো ভাষাবিজ্ঞানী উপহার দিয়েছিল। অথচ এই মহাপন্ডিতের উত্তরসুরিরা তারই বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারছেনা – এটা খুবই আফসোসের বিষয়।

আমি আশা করব আমাদের দেশের সরকার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা আছেন তারা এ বিষয়টি নিয়ে ভাববেন এবং কার্যকরী উদ্যোগ নেবেন। ২৪ বছর হল ২১শে ফেব্রুয়ারী কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। শুধু এই দিনের নাম ভাঙ্গিয়ে আর কত খাব আমরা? বিশ্বের দরবারে ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে অবদান রাখার জন্য কি আমরা এগিয়ে আসবনা? আমাদের নিজের দেশের সমৃদ্ধশালী ভাষাগুলোর ঐতিহ্য কি আমরা বিশ্ববাসীকে জানাবনা? আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলি নিয়ে কি আমরা গবেষণা করবনা? আমাদের দেশের পাহাড়ী অঞ্চলের অবলুপ্তগামী ভাষাগুলোকে বাঁচানোর উদ্যোগ কি আমরা নেবনা? যদি না নেই, তবে কে নেবে? এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করার কি কেউ আছে? আমি একজন সমাজভাষাবিজ্ঞানী (sociolinguist)। আমি আমার জগতে কাজ করে যাব, আর এতে যদি বাংলা ভাষায় গবেষনার ক্ষেত্রটা একটু সমৃদ্ধ হয়, তবে তার চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? তবে আমার গবেষণার পরিধি স্বাভাবিকভাবেই সীমিত, যদিও নতুন নতুন বিষয়ে গবেষণা করতে আমার ভাল লাগে। কিন্তু বড় আকারের গবেষণা করতে হলে রাষ্ট্রীয় সাহায্য ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ লাগে। সেই অবস্থা কি আদৌ আমাদের দেশে হবে?

আমি খুবই খুশি হব যদি কেউ আমাকে ভুল প্রমাণ করে জানান যে আমি যেসব আফসোসের কথা লিখেছি, তা ঠিক নয় এবং বাংলাদেশে অনেক ভাষাবিজ্ঞানী আছেন এবং তারা নিয়মিত গবেষণা করছেন। যদি তা হয়ে থাকে তবে আমি খুবই অবাক হব, এবং এর সাথে সাথে আমার ভুল ধারনার জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাব।

Leave a Comment