লিখাটি ১ সেপ্টেম্বর ২০২২ আমারদেশ ইউকে তে প্রকাশিত হয় https://amardesh.co.uk/post-editorial/details/897
প্রযুক্তি কখনো খারাপ কিছু হতে পারেনা কারন এটা মানুষের সৃষ্টিশীলতার এক অনুপম নিদর্শন। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ এখন ব্যক্তিগত ও সামাজিক যোগাযোগ রক্ষায় এক বিপ্লবের আবির্ভাব ঘটিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সৌজন্যে। ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা আমাদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবরা কে কি করছে তা তৎক্ষণাৎ জানতে পারছি। টুইটারের মাধ্যমে আমরা মুহূর্তের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দিতে পারছি ও অন্যদের মতামত জানতে পারছি। ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে আমরা আমাদের ছবির আর্কাইভ করার পাশাপাশি অন্যদের ছবি দেখতে পারছি। আর ওয়াটস্যাপের মাধ্যমে আমরা ব্যক্তিগত ও গ্রুপ পর্যায়ে সারা বিশ্বে আমাদের পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি অডিও-ভিডিও কল করতে পারছি। নিঃসন্দেহে এই প্রযুক্তিগুলি আমাদের জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে।
কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তখন যখন আমরা এসব প্রযুক্তির অপব্যবহার করি। সোশাল মিডিয়া খুললেই এসব অপব্যবহার লক্ষ করা যায়। সোশাল মিডিয়ার অপব্যবহারের আধিক্যে প্রায়ই এসব মিডিয়া এখন সমাজের ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটা শুধু তরুণ সমাজের উপর প্রযোজ্য নয় – ছোট বড় নির্বিশেষে আমরা সবাই সোশাল মিডিয়ার অপব্যবহার করে সমাজের ক্ষতি করছি। এরই কিছু উদাহরণ আজকের লিখায় তুলে ধরার চেষ্টা করব।
সামাজিক না অসামাজিক মাধ্যম?
কয়েকবছর আগে তুর্কীর ইজমির বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কনফারেন্সে গিয়েছিলাম। সেখানে একজন আমেরিকান প্রফেসারের কীনোট পেপারের মুল বক্তব্য ছিল কিভাবে আমরা সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে অসামাজিক হয়ে যাচ্ছি। এখন আমরা আত্মীয় বা বন্ধুদের বাসায় যাওয়ার চাইতে ফেসবুকে সময় কাটানো বেশী পছন্দ করি। বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে বর্তমানে চা এর আড্ডা কমে যাচ্ছে। আর চায়ের আসরে বসলেও দেখা যাচ্ছে সবাই তাদের মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। ছোট বেলায় আমরা বিকেল হলে বাইরে খেলতে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যেতাম। এখন বাইরে যাবার সেই আকাঙ্ক্ষা আগের মত নেই। ফলে বাইরের খোলা বাতাসে খেলাধুলার মাধ্যমে শরীরচর্চার পরিবর্তে বর্তমান প্রজন্ম ঘরে বসে মোবাইল, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ ইত্যাদির পেছনে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করে যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আগে সামাজিক যোগাযোগ বলতে আমরা সশরীরে দেখা সাক্ষাতকেই বুঝতাম। বন্ধু মহলে হোক বা আত্মীয়দের মাঝে, আমাদের মধ্যে যোগাযোগ হত সরাসরি এবং সামনাসামনি। এখন সব ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিতে আমরা উন্নত হলেও সোশাল স্কিল, অর্থাৎ মানুষের সাথে সাক্ষাতের সময় কিভাবে কথা বলতে হয়, সেই স্কিল বা পারদর্শীতা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এর ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সোশাল স্কিলের ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে।
অভদ্রতা ও অশালীনতার অভয়ারণ্য
যখন আপনি কারও সাথে সাক্ষাৎ করবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনি ন্যুনতম ভদ্রতা বজায় রাখবেন, কারন একেবারে ইতর প্রকৃতির মানুষ ছাড়া কেউ সরাসরি কাউকে অপমান করে না। কিন্তু ভদ্রতা বজায় রাখার মুল উৎস সশরীরে দেখা না হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এখন অভদ্রতা ও অশালীনতার তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। গালাগালি ও অসভ্য ভাষা ব্যবহার এসব অনলাইন প্লাটফর্মে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘরে বসে কী বোর্ড ব্যবহার করেই চলছে এসব কার্যক্রম। এই অসভ্যতা কোন নির্দিষ্ট দেশে বা সমাজে সীমাবদ্ধ নেই – সারা পৃথিবী জুড়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একই অবস্থা। এটা মূলত: দেখা যায় কোন পাবলিক ফিগারের সোশাল মিডিয়া একাউন্টে বা কোন ইউ টিউব বা ফেসবুক ভিডিওর কমেন্ট সেকশনে। অনেকে স্বনাম ব্যাবহার না করে ছদ্মনাম দিয়ে এ ধরনের কমেন্ট করে থাকে। কারও কোন কথা বা কাজ অবশ্যই সমালোচনার যোগ্য হতে পারে। কিন্তু সেই সমালোচনা করতে গিয়ে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় গালাগালি করতে হবে কেন? কাউকে অভদ্র ভাষায় অপমান করে যারা আত্মতৃপ্তি বোধ করে, তাদের চিন্তাভাবনা ও রুচি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হয়। এ ধরনের মানুষদের সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিৎ।
সময় অপচয়ের তীর্থকেন্দ্র
এই দোষে আমি নিজেও দোষী এবং খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রয়োজনের অধিক সময় ব্যয় করেননা। দিনে কয়বার যে আমরা ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, ওয়াটস্যাপ ইত্যাদি স্ক্রল করতে থাকি তার হিসেব নেই। কে কি করল, কে কি ভাবছে, কে কি ছবি আপলোড করল ইত্যাদি নিয়েই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটে যায়। সন্দেহ নেই এর মধ্যে অবশ্যই কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসে যায়, যেমন কোন বন্ধু বা আত্মীয়ের খবরাখবর, কোন চিন্তা উদ্রেককারী স্ট্যাটাস, বা কারও শেয়ার করা কোন খবর, বা প্রবন্ধ বা ভিডিও ইত্যাদি। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, অধিকাংশ সময়ে আমরা অপ্রয়োজনীয় কাজেই সোশাল মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকি। হয় আমরা নিজেরা অপ্রয়োজনীয় জিনিষ শেয়ার করে সময় নষ্ট করি, অথবা অন্যের শেয়ার করা অপ্রয়োজনীয় স্ট্যটাস পড়ে সময় ব্যয় করি। আগে অবসর সময় আমরা বই পড়ে বা গল্প করে কাটাতাম। এখন অবসর সময়তো বটেই, কাজের সময়ও আমরা সোশাল মিডিয়ায় কাটাই। এতে আমাদের শারীরিক ও মানসিক লাভ বা ক্ষতি নিয়ে সবার মূল্যায়ন করা এখন সময়ের দাবী।
ফেসবুক ফ্রেন্ড বনাম আসল ফ্রেন্ড
আচ্ছা, আপনার ফেসবুক একাউন্টে কতজন বন্ধু আছে? এর মধ্যে কতজন আপনার প্রকৃত বন্ধু? কতজনকে আপনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন? কতজনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা আপনার প্রয়োজন? জানিনা আমরা কতজন এসব কথা ভেবে আমাদের সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করি। এ ব্যপারে আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। অনেকের মত আমি নিজেও প্রথমদিকে সবার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট গ্রহণ করতাম এবং বাংলাদেশীদের মধ্যে আমার পরিচিতি একটু বেশী থাকায় কিছুদিনের মধ্যেই আমার ফ্রেন্ডের সংখ্যা ৫০০০ পার হয়ে যায় এবং প্রচুর ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসতে থাকে। কিন্তু ফ্রেন্ড লিস্টের ৯০% মানুষকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতামনা। তাই ফেসবুক চালানোর মুল উদ্দেশ্য, যা আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, তা কঠিন হয়ে পড়ছিল। ফলে আমি আরেকটি ফেসবুক একাউন্ট খুললাম যেখানে শুধুমাত্র যাদের ব্যক্তিগতভাবে চিনি, তাদের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করি। সেই একাউন্টে মাত্র ৫৩০ জন ফ্রেন্ড আছে। অন্যদিকে আমার আগের একাউন্টে ৫০০০ অপরিচিত ফ্রেন্ড রক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম অযথা সময় বেশী দিতে হচ্ছে ফেসবুকে। তাই সেই একাউন্ট ব্যবহার না করে এখন ফেসবুক পেজের মাধ্যমে আমার লেখালেখি বা ভিডিও সাধারন মানুষের সাথে শেয়ার করি। আমার এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে অনেক পাঠক নিজেদের ফেসবুক একাউন্ট কিভাবে চালান তা তুলনা করে দেখতে পারেন। মোদ্দা কথা হচ্ছে, যারা অপরিচিত, তাদের সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ আমরা বেশী রাখি না যারা আসল বন্ধু তাদের সুখ-দুঃখে তাদের পাশে থাকি তা এখন বিবেচনা করে দেখার প্রয়োজন।
অতিরিক্ত শেয়ারে সবাই কাতর
এই সমস্যাটা মূলত: ওয়াটস্যাপে যদিও ফেসবুকেও এই কাজটি করা হয় অহরহ। ফেসবুকে কে কি শেয়ার করল তা আমাদের এতটা বিরক্ত হয়তো করেনা, কারন আমরা তা না দেখে স্ক্রল করতে পারি। কিন্তু প্রতিদিন ওয়াটস্যাপে যে মেসেজের বন্যা বইতে থাকে তা থেকে বাঁচার উপায় কি? আপনি যদি আমার মত হয়ে থাকেন যে ফোনে নোটিফিকেশন সাইন থাকলে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সেটি ওপেন করার অভ্যাস থাকে, তবে তো বিপদের শেষ নেই। প্রতিদিন কত লোক যে কত মেসেজ, ভিডিও লিঙ্ক, ছবি শেয়ার করতে থাকেন তার ইয়ত্তা নেই। শুধু তাই নয়, শেয়ার করার অভ্যাস যাদের আছে, তারা যদি আপনার সাথে একাধিক গ্রুপ চ্যাটে থাকেন, তবে সব গ্রুপে একই জিনিষ পাঠাতে থাকেন। যারা এই কাজটি করেন তারা কি জানেন যে সবাই এসব মেসেজ পাইতে চান কিনা? কোন বিষয়ে কেউ যদি নিজের মতামত দিতে চান বা নিজের কোন লিখা বা ভিডিও শেয়ার করতে চান, তবে এতে আমার আগ্রহ আছে। কিন্তু অন্যের পাঠানো ভিডিও বা মেসেজ শেয়ার করতে হবে কেন? যাকে পাঠাচ্ছেন, তিনি কি আপনার সেই ফরোয়ার্ড করা মেসেজ দেখতে আগ্রহী?
যাচাই না করেই শেয়ারের প্রবণতা
এই অভ্যাসটা অত্যন্ত মারাত্মক কিন্তু অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত যারা যাচাই বাছাই না করেই একের পর এক ভিডিও বা ছবি বা খবর ফেসবুক ও ওয়াটস্যাপে শেয়ার করতে থাকেন। যাচাই না করে কোন খবর ছড়ানো ইসলামে নিষেধ, কিন্তু কতজন এটা মানেন? ফেক নিউজের এই জমানায় সাবধান হবার পরিবর্তে সোশাল মিডিয়ায় না বুঝেই শেয়ার করার মানুষের সংখ্যা প্রচুর। আমি তাই কেউ কিছু শেয়ার করলে, তা প্রথমে কোন উৎস থেকে সেই খবর এসেছে তা যাচাই করি। তারপর বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ সংস্থার ওয়েবসাইটে গিয়ে সেসব খবরের সত্যতা যাচাই করে নিশ্চিত হই এমন কোন ঘটনা সত্যি ঘটেছে কিনা। দু একটি উদাহরণ দেই। মাইকেল জ্যকসনের মৃত্যুর পর গজব ছড়িয়ে যায় যে সে মুসলমান হয়েছিল এবং একটি গান প্রচার হতে থাকে এর প্রমান স্বরূপ। অথচ সে গানটি ইরফান মাক্কি নামক একজন নাশীদ শিল্পীর গাওয়া। আরেকবার বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত সাংবাদিক নুরুল কবীরের নামে একটি ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায় যেখানে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। নুরুল কবীর নিজে এটা অস্বীকার করার পরও এখনও মাঝে মাঝে সেই পোস্টটি শেয়ার হচ্ছে। এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণা ও না জেনে এসব শেয়ার করা খুবই দুঃখজনক এবং পরিহারযোগ্য।
শেষ কথা
আমরা যারা সোশাল মিডিয়ায় এক্টিভ তারা প্রত্যেকেই এক একটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান, কারন আমাদের মাধ্যমে মানুষ অনেক খবরাখবর পায়। তাই সোশাল মিডিয়া ব্যবহারের সময় আমাদের সবার আরেকটু সতর্ক ও দায়িত্ববান হওয়া উচিৎ। তাই আমি আমার নিজেকে ও পাঠকদের সবাইকে আবেদন জানাতে চাই যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আধিক্যে আমরা যেন প্রকৃত সামাজিকতা ভুলে না যাই। আমরা যখন কমেন্ট করব তখন একটু ভেবে দেখব যে আমাদের ভাষা যেন অন্যের মনে কষ্ট না দেয়, আর যারা গালাগালি করে তাদের আমরা সে কাজ থেকে বারণ করব, এবং সংশোধন না হলে তাদের আনফ্রেন্ড করব। সোশাল মিডিয়ায় আমরা যে সময় ব্যয় করি তা পরিমিত কিনা এবং তা সময়ের অপচয়ের পর্যায়ে যায় কিনা তা আমরা লক্ষ রাখব। আর সর্বোপরি, যাচাই না করে আমরা কোন সংবাদ বা ভিডিও শেয়ার করা থেকে বিরত থাকব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভাল দিকগুলি আমরা কাজে লাগাব এবং এর যে খারাপ দিক আছে সেগুলোর অপকারিতা থেকে নিজেকে এবং অন্যদের মুক্ত রাখার চেষ্টা করব।
জানি এ কথাগুলো বলা সহজ, কিন্তু করা কঠিন। তারপরও এ বিষয়গুলো তুলে ধরতে চেষ্টা করলাম এই আশায় যে আমরা এসব বিষয়ে আরেকটু সচেতন হব। এখন সময় হয়েছে বিবেচনা করার যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমাজের একটি এডিকশনে পরিণত হয়ে গেছে কিনা এবং তা সমাজের উপকার থেকে অপকার বেশী করছে কিনা।