নাবীল – হৃদয়ে তুমি ছিলে, আছ, থাকবে

বারটস ক্যন্সার হাসপাতালে নাবীলের সাথে খুব চমৎকার সময় কাটানোর সময় তোলা

নাবীল, আজ তোমার ইন্তেকালের এক বছর পার হলো। গত একটি বছরে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। শুধু পরিবর্তন হয়নি তোমার অভাবে আমার জীবনের শূন্যতা। আমার নিজের, তোমার চাচীর, নাবা, সাফা ও হানার অনেক কথা বলার ছিল তোমার সাথে। অনেক পরামর্শের প্রয়োজন ছিল। মাঝে মাঝে এমনও মনে হয়েছে, “নাবীলকে ফোন করে পরামর্শ নেব”, এবং সাথে সাথে মনে হয়েছে, তুমি চলে গেছ অনেক দুরে। তোমাকে পাওয়ার উপায় নেই। তোমার শূন্যতা দুর হবার উপায় নেই। তোমার সেই হাসি মুখ দেখার উপায় নেই।

এখনও স্পষ্ট মনে আছে গত বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের সেই দিনটির কথা। তোমাকে দেখার জন্য আমি ও তোমার চাচী রাতে রওয়ানা হয়ে লন্ডনের কাছে এক হোটেলে ফজরের নামাজের পর শুয়েছি, যখন তোমার ফোন এল। তুমি যে সংবাদ দিলে তা আমার মনের ভেতরে প্রচণ্ড এক আঘাত দিল। তোমার ক্যন্সার এত বেশী এগ্রেসিভ যে খুব বেশীদিন তোমার হাতে নেই এ কথা আগেরদিন রাতে ডাক্তাররা তোমাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে। কিন্তু তুমি হেসে হেসে কথা বলছ আমার সাথে। আমি ও তোমার চাচী কাঁদছি, আর তুমি আমাদের সান্ত্বনা দিচ্ছ। মনে আছে তোমার দৃঢ় কণ্ঠের সেই কথাগুলি, “আল্লাহর ফায়সালা হওয়ার আগে ডাক্তারদের ফায়সালা মানতে আমি রাজী নই। আমি লড়াই করে যাব। যদি আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন তবে আপনাদের মাঝে আমি আরও কিছুদিন থাকব। আর যদি আল্লাহ আমাকে নিয়ে যাওয়ার ফায়সালা করেন, তবে আমি আমার আম্মু, দাদা ও নানার সাক্ষাৎ পাব। আমার জন্য তো দুটিই আকর্ষণীয় ও লাভজনক ব্যপার।” অবাক হয়েছিলাম একজন মত্যু পথযাত্রীর ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা দেখে। তোমার চিন্তা নিজেকে নিয়ে ছিলনা, ছিল তোমার নিকটজনদের নিয়ে। আমাকে তুমি দায়িত্ব দিলে আমার গাড়ীতে যেন তোমার আব্বুকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। তুমি নিজে এ খবরটি তাঁকে আমার সামনে দিতে চেয়েছিলে।

এরপর কয়েকটি মাস আমাদের পুরো পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু ছিলে তুমি। এমন কোন নামাজ নেই যার পর তোমার জন্য দোয়া করিনি। রোজার মাসে দোয়া কবুলের প্রতিটি ক্ষণে আল্লাহর দরবারে ধরনা দিয়েছি তোমার জন্য। মিনতি করেছি তোমাকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। তিনি জানেন কি সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ। তবে তোমাকে নেয়ার আগে আল্লাহ তোমাকে দিয়ে অসাধারণ কাজ করিয়ে নিয়েছেন। আমরা চেয়েছি তোমাকে জীবিত দেখতে, কিন্তু তিনি চেয়েছেন তোমাকে চিরজীবী রাখতে তোমার কাজের মাধ্যমে। তাইতো তুমি হাসপাতালের বিছানায় বসে, শরীরের নীচের অংশ সম্পূর্ণ প্যারালাইসিস অবস্থায় রাসুল (সঃ) এর নেতৃত্বের গুণাবলী নিয়ে একটি কালজয়ী বই লিখে ফেললে যা ইতিমধ্যে ইউকে সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আল্লাহর রহমতে ২৭শে রামাদান তোমার বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হয় এবং তুমি তখন খুব অসুস্থ্য থাকলেও ঠিক ঐ অনুষ্ঠানের জন্য আল্লাহ তোমাকে স্বল্প সময়ের জন্য সুস্থ্য করে দেন। এর পরেই ধীরে ধীরে তোমার অবস্থার অবনতি হতে থাকে, তোমার ক্যন্সার মগজে ঢুকে পড়ে ও তোমাকে হসপিসে নিয়ে যেতে হয়। বোঝাই যায় আল্লাহ কিভাবে সবকিছু পরিকল্পনার মাধ্যমে তোমাকে ধীরে ধীরে আমাদের মাঝ থেকে নিয়ে গেলেন।

নাবীল, তোমার বই সর্ব মহলে বহুল প্রশংসা পেয়েছে। এটা তোমার বিরাট সাদকায়ে জারিয়া। কিন্তু যে কারণে তুমি সবার মন কেড়ে নিয়েছিলে তা হচ্ছে অসুস্থ্য অবস্থায় আল্লাহর প্রতি তোমার অবিচল আস্থা ও অসম্ভব ধৈর্য। আমরা যখন তোমাকে নিয়ে পেরেশান, তখন তোমার কাছে গেলে আমাদের সবার মন ভাল হয়ে যেত। তোমাকে যখন হাসপাতাল থেকে বাসায় সেবার ব্যাবস্থা করা হল, তখন তোমাকে দেখতে একরাত আমরা তোমার বাসায় কাটালাম। পরদিন সকালে তোমার সাথে কয়েক ঘণ্টার সময়টা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। তোমার হাসি ও প্রাণোচ্ছল কথা আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছিল তোমার অসুস্থ্যতার কথা। তার কিছুদিন পর তোমার অবস্থার অবনতি হওয়ায় তোমাকে হসপিসে নেয়া হল। আমাদের পুরো বৃহত্তর পরিবার একদিন মিলিত হলাম সেই হসপিসে। তখন তোমার মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা। এর মধ্যে তুমি সবার উদ্দেশ্যে তোমার বই থেকে কিছু আলোচনা করলে। তারপর তোমার লিখা বইয়ে আমার জন্য কিছু সুন্দর লিখা নাসরীনকে দিয়ে লিখালে। এরপর কাঁপা হাতে এর নীচে স্বাক্ষর করলে। কাঁদতে কাঁদতে হসপিস থেকে বের হলাম এটা বুঝে যে তোমার হাতে সময় আর বেশী নেই। এটাই তোমার সাথে আমার শেষ কথোপকথন। এর সপ্তাহ খানেক পর থেকেই তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে।

শেষ দিনগুলিতে যেই তোমাকে দেখেছে সেই মনে করেছে যে তোমার কোন কষ্টই হচ্ছেনা। তুমি নীরবে বাসায় পরিবারের মধ্যেই ছিলে। ডাক্তাররা বলল যে যেহেতু তুমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত তাই তোমার শরীর আর লড়াই করছেনা, তাই তোমার কষ্টও কম হচ্ছে। এভাবেই ঈদুল আযহার দুদিন পর খুব ভোরে মেজ ভাইয়া ফোন করে জানালেন তুমি আর নেই। ফোন করে তোমার আব্বুর সাথে কথা বললাম। তাঁর ধৈর্য দেখে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালাম। ফেসবুকে তোমার ইন্তেকালের খবর দিয়ে একটি আবেগী পোস্ট দিলাম । কিছুক্ষণের মধ্যে ফেসবুকে তোমাকে নিয়ে পোস্টের সয়লাব বয়ে গেল। আমরা তোমাকে ভালবাসতাম। কিন্তু তোমাকে এত লোক ভালবাসত তা জানতামনা। অভিভূত হলাম অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে লিখা সেসব আবেগী পোস্টের ভাষায়। সবার কোথায় একটি কমন বক্তব্য – কিভাবে তুমি তাদের ব্যাক্তিগত জীবনে বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছিলে।

এটাই তোমার চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল। সারাজীবন অন্যদের কল্যাণ নিয়েই ভেবেছ। তোমার হাসপাতালের রুম ছিল একটি কনসালটেন্সি রুম। এথিক্যাল লিডারশীপ ছিল তোমার বিশেষত্ব। ইউকে ও বিশ্বের বহু দেশে তুমি লিডারশীপ ট্রেনিং দিতে ও ছিলে অত্যন্ত জনপ্রিয়। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে প্যারালাইসিস অবস্থায় তুমি বড় বড় ইসলামী প্রতিষ্ঠানের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে দিয়েছ। এমন কি বিখ্যাত বারটস ক্যন্সার হাসপাতালের সিনিয়র কর্মকর্তাদের ফ্রি কনসালটেন্সি দিয়েছ। আমাকে তোমার কনসালটেন্সি ফার্মে কিভাবে কাজে লাগান যায়, তোমার চাচী কোন দিকে ক্যরিয়ার এগিয়ে নিতে পারে, আমার মেয়ে সাফা কিভাবে ইসলামী কাজে আরও সক্রিয় হতে পারে – সবকিছু নিয়ে চিন্তা করতে।

মাত্র ৩৯ বছর পেয়েছিলে এই পৃথিবীতে। পুরো জীবনটা অন্যের জন্যেই কাটিয়েছ। তোমার আম্মু যখন ইন্তেকাল করেন, তখন তোমার বয়স মাত্র ২৪। তোমার আব্বু জেদ্দাতে থাকায় ছোট ভাইবোনদের দেখাশুনার দায়িত্ব তুমিই পালন করেছ। তুমি ও তোমার স্ত্রী নাসরিন ওদের শুধু দেখাশুনাই করনি, ওদের বেশীরভাগের বিয়ের দায়িত্ব পালন করেছ। তাদের ব্যাপারে প্রায় আমার কাছে পরামর্শ করতে। তাদের জন্য তোমার ভালবাসা ও দায়িত্ববোধ আমাকে অভিভূত করত। শুধু আপন ভাই-বোন নয়, বংশের সবচেয়ে বড় হিসেবে সবার প্রতি ছিল তোমার মমত্ববোধ ও ভালবাসা। তুমি ছিলে সবার প্রিয় ‘বড় ভাইয়া’।

তোমার লাশ দেখতে পাই তোমার মৃত্যুর পরদিন ইস্ট লন্ডন মসজিদের মর্গে। তোমার অসিয়ত অনুযায়ী তোমার লাশ গোছলে আমারও ছোট্ট ভূমিকা ছিল। তোমার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম কি সুন্দরভাবে ঘুমাচ্ছ তুমি। কোন কষ্ট নেই, মনে হয়েছে সুরা আল ফজরে যে ‘প্রশান্ত আত্মার’ কথা বলা আছে, সেই প্রশান্ত আত্মা আমার সামনে। অনেক কেঁদেছি। তোমার জন্যে কোন আশঙ্কায় নয়, কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহ তোমার মত বান্দাকে খুব ভালভাবেই রাখবেন। কেঁদেছি তোমার সন্তানরা যখন তোমার লাশের দিকে তাকিয়ে ছিল সে দৃশ্য দেখে। কেঁদেছি নাসরিন যখন তোমার লাশের সামনে বাচ্চাদের সুন্দর করে বোঝাচ্ছিল সে দৃশ্য দেখে। ছোট্ট সামীর, মাত্র চার বছর বয়স। কিভাবে তাকিয়ে ছিল তোমার দিকে তা দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আর অনেক কেঁদেছিলাম নিজের কথা ভেবে। কার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে গল্প করব? ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় নিয়ে কার সাথে মন খুলে কথা বলব? তোমার শূন্যতা কিভাবে পুরণ হবে?

একটি বছর পার হল তুমি চলে গেছ। শুধু রয়েছে তোমার স্মৃতি। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ওয়াদা করেছেন যে বোঝা বইতে পারবেনা এমন বোঝা তিনি কারো উপর চাপান না। সেটাই প্রমাণিত হল আবার। তোমার আব্বুকে আল্লাহ অনেক ধৈর্য দিয়েছেন, ধৈর্য দিয়েছেন নাসরিন ও বাচ্চাদেরও। প্রতি মুহূর্তে তারা তোমার অভাব অনুভব করে। কিন্তু আল্লাহর সিদ্দান্ত তারা মেনে নিয়েছে। তারা ভালই আছে আলহামদুলিল্লাহ।

না, তোমাকে ভুলিনি নাবীল। তোমার শূন্যস্থানও পূরণ হয়নি। জীবন এগিয়ে চলছে তোমাকে ছাড়া । কিন্তু হৃদয়ে তুমি ছিলে, আছ, থাকবে। দোয়া করি মহান রাব্বুল আলামীন তোমাকে ভাল রাখুন, তোমার সমস্ত গুনাহ মাফ করুন, তোমার আকাংখামত তোমার প্রিয়জনদের সাথে তোমাকে রাখুন, এবং তোমার জন্য জান্নাত ফয়সালা করুন।

25 thoughts on “নাবীল – হৃদয়ে তুমি ছিলে, আছ, থাকবে”

  1. Subhan Allah so inspiring. Not only because of the man Nabeel was but how you put your heart and soul into this extraordinary post that will touch everyone with a human feelings. I taught Nabeel many things but he taught me more during his terminal illness as to how much he was aligned with the will of our most merciful Allah.

    Reply
  2. অনেক আবেগময় লেখা।আল্লাহ প্রিয় নাবিলকে কবুল করুন। জান্নাতে আমাদের আবার এক করুন।

    Reply
  3. হ্রদয় ছুয়ে গেল নাবিলের লেখাটি পড়ে।আল্লাহ পাক আপনাদের সংসারে তথা প্রতিটি ইসলামী পরিবারে এমন নাবিল দান করুন।এবং বিদেহী নাবিলকে জান্নতের মেহমান বানিয়ে নিন।

    Reply
  4. Assalamu Alaikum. Salman I read the post full of emotion, love and hope you penned down. I felt very proud of Nabil going through his great work on leadership of prophet Muhammad (SM).
    May Allah rest Nabil in the gloriest part of Jannatul Ferdaous. Ameen.
    Please keep us in your doa.

    Reply
  5. ভাই, বইটা কিভাবে পাইতে পারি জানাবেন প্লিজ। আল্লাহ প্রিয় ভাইকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। আমিম

    Reply
  6. চোখে কোনে পানি আমার!!! কি সুন্দর স্মৃতিচারণ!!! আল্লাহ মরহুমকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করুন।

    Reply
  7. চোখের পানি আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। আপনার নিপুণ হাতের লেখা যে কারো হৃদয় স্পর্শ করবে সন্দেহ নেই।

    Reply
  8. আপ্লুত,,,,।
    আল্লাহ নাবিলকে মর্যাদার আসনে রাখুন, আমীন,,,🤲

    Reply
  9. আল্লাহ তার ভুল গুলোকে ক্ষমা করে জান্নাতের মেহমান হিসাবে কবুল করুন আমীন ইয়া রব

    Reply

Leave a Comment